কৌতূহলের জালে
অনিকের কাল কলেজে রসায়ন দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষা। সন্ধ্যায় মায়ের হাতের পায়েস খেয়ে টেবিলে বসলো জৈব যৌগ নিয়ে। কিন্তু মাথা থেকে কিছুতেই তার এক ভূত দূর হচ্ছে না। আজ কলেজে অধ্যাপক জামিলুর রহমান এসেছিলেন পরিদর্শনে।বলে রাখা ভালো জামিলিউর রহমান সাহেব নিতান্তই একজন সরল মনের মানুষ।তাই কলেজে ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে সকলের কাছেই খুবই পছন্দের একজন মানুষ তিনি। তবে অনিকের কাছে যে বিশেষ কারণে জামিলুর রহমান স্যারকে ভালো লাগে তা হলো মানুষটা বিজ্ঞান দিয়ে সবকিছু চিন্তা করেন। পরিদর্শনে আসলেই বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কার নানা রকম বিস্ময়কর ঘটনা ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে তুলে ধরেন। এই তো গত সপ্তাহেও বৃহস্পতিবার তিনি ইলন মাস্কের টেসলা কোম্পানি নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের মজার সব তথ্য দিলেন। আজ তিনি পরিদর্শনে এসে গল্প করার মাঝে হঠাৎ বলে উঠলেন,"তোমরা কি জানো মঙ্গল গ্রহও একদিন পৃথিবীর মানুষের বসবাসের উপযোগী হবে?" অনিক সাথে সাথেই প্রশ্ন করে বসলো,"স্যার এটা কি করে সম্ভব?" তবে দুর্ভাগ্যবশত অনিকের কৌতূহলটি আর শেষ পর্যন্ত পূরণ হয়ে উঠল না। সে প্রশ্ন করার সময় জামিলুর রহমান স্যারের ফোন ক্রিংক্রিং করে বেজে উঠল। তারপর তিনি চিন্তিত মুখে ফোন কানে দিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন। অনিক বুঝতে পারলো ফোনটা জরুরী। সেই থেকে প্রশ্নটা অনিকের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ঠিক যেমন পৃথিবী সূর্যের চারদিকে কক্ষপথে ঘোরে। কিছুক্ষণ যাবার পর অনিক কিছুটা ঝিমুতে শুরু করলো। তার কিছুক্ষণ পর যা ঘটল তার জন্যে সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। অনিক নিজেকে আবিষ্কার করল ভিন্ন এক জায়গায়। কিছুক্ষণ পরপর সে বিভিন্ন উপত্যকা, মরুভূমি ও মরুস্থ হিম পর্বত দেখছে। কিছুটা ঘাবড়ে গেলো অনিক। এটা কোথায় এসে পড়ল সে ? আরো কিছু দূর যাওয়ার পর সে শুনতে পেলে অদ্ভুত এক গলায় কেউ একজন বলছে "লাল গ্রহে স্বাগতম মিঃ অনিক!" অনিক চমকে উঠে পেছনে তাকিয়ে দেখল কিছুটা রোবটের মত মাথায় ২ এন্টেনা বিশিষ্টযুক্ত বেটে স্বভাবের কেউ একজন তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে। অনিক বিস্ময়ের সুরে বললো," লাল গ্রহ মানে? তোমার নাম কি? আমি কোথায় আছি?" অচেনা সেই সুর বলে উঠলো," আহা তুমি এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? আমার নাম কেমি।আমরা এখানকারই বাসিন্দা। এখানে আসার সময় খেয়াল করোনি গ্রহটি যে বাইরে থেকে লাল দেখাচ্ছে? মূলত তোমার পায়ের নিচে থাকা ফেরিক অক্সাইডই এর জন্যে দায়ী।" আসলেই তো গ্রহটা যে লাল দেখাচ্ছে এটা অনিকের একদমই খেয়াল করা হয়নি।অনিক বুঝতে পারছে না সে কি বলবে। সে এবারে সোজাসুজি হাঁটা শুরু করল হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে একটি বিশাল পর্বত দেখে থেমে গেল অনিক। এত উচ্চতম সে পর্বত যে পর্বতটির সামনে তাকে দেখতে একটি ছোট অণুজীবের মত লাগছিল। পাশ থেকে কেমি বলে উঠলো,"এটির নাম 'অলিম্পাস মনস'।এটি সৌরজগতের সবচেয়ে বৃহত্তম পর্বত।" অনিক মাউন্ট এভারেস্ট টিভিতে একবার দেখেছিল। এবারে 'অলিম্পাস মনস' সামনে থেকে দেখে সে উপলদ্ধি করলো এই মহাবিশ্বের কাছে মানুষের জীবন আসলে কতটা নগণ্য। অনিক এবার নিজেকে সামলাতে না পেরে বলে উঠল,"আমার একটা প্রশ্ন আছে।" কেমি উত্তর দিল," এখানে মানুষের বসবাস সম্ভব কিনা তাই জানতে চাচ্ছে?" "আশ্চর্য তা তুমি কি করে জানলে?" "এটি এলিয়েনদের একটি বিশেষ পাওয়ার বলতে পারো। আমরা চাইলেই যে কারো মনের কথা বুঝতে পারি। তোমরা মানুষরা যা পারো না। যাই হোক শোনো তাহলে,তোমাদের মানুষদের বসবাসযোগ্য পৃথিবী গ্রহের মতই মঙ্গল গ্রহটি। তার কিছু কারণ আছে। অনিক উত্তেজিত সুরে বলল,"কি কারণ?" "বলছি। তোমাদের মানুষদের মাঝে ধৈর্য অনেকটা কম।" এই বলেই কিমি হাঁটতে লাগলো আর অনিক তার পিছন পিছন যেতে লাগলো। "তোমাদের দিনরাত কয় ঘন্টায় হয় বলতো?" অনিক উত্তর দিল,"২৪ ঘন্টা"। "হ্যাঁ, ২৪ ঘন্টায়। মঙ্গল গ্রহেও দিনরাত প্রায় 24 ঘন্টাতেই হয় । মঙ্গলের সমতল ভূমি ও পৃথিবীর আয়তনের প্রায় ২৮.৪%। তাই একে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর জমজ ভাই বলেও ডেকে থাকেন। তবে এর ঘনত্ব পৃথিবীর চেয়ে কম এবং আয়তনে ক্ষুদ্রতর প্রায় ১৫% বলা চলে।" অনিক বললো," আচ্ছা, পৃথিবীর মতো এই গ্রহেরও কি ঋতু আছে?" কেমি বলল, "অবশ্যই আছে । পৃথিবীর মতোই সূর্যের চারদিকে আবর্তন কালে গ্রহের যে অংশ সূর্যের দিকে ঘুরে থাকে সেখানে গ্রীষ্ম এবং বাকি অর্ধেকের শীতকাল ঘটে। তারপর আবার উল্টো হয় অর্থাৎ এখানে দুইটি ঋতু শীত এবং গ্রীষ্ম।" এ পর্যায়ে কিমি কিছুক্ষণ থামলো অনিকের কৌতূহল ক্রমাগত বাড়েই চলেছে। সে বলল,"তাহলে তো এখানে মানুষের থাকার কোন সমস্যাই হবার কথা না। জামিলুর রহমান স্যার ঠিকই বলেছিলেন।মঙ্গল গ্রহ একদিন মানুষের থাকার জন্য উপযোগী হবে।" কেমি অনিকের দিকে শান্তভাবে তাকিয়ে বলল,"স্যার ঠিকই বলেছেন, এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবে এটি এখন পর্যন্ত সম্ভব নয়। ভবিষ্যতে হবে কিনা এ নিয়ে নাসার বিস্তর গবেষণা চলছে। মূলত অনেকখানি মিল থাকা সত্ত্বেও উচ্চ বিকিরণ, অতিশয় সংকুচিত বায়ুর চাপ এবং ০.১৬% অক্সিজেন দ্বারা গঠিত বায়ুমণ্ডল বিশিষ্ট থাকায় এই গ্রহ মানুষ বা অন্যান্য প্রাণীর বসবাসযোগ্য নয়।" এবারে অনিকের কিছুটা মন খারাপ হয়ে গেল । বোধহয় কিমি বিষয়টা বুঝতে পারল। কেমি বলল," তবে অনেকে এগুলোকে বড় বাধা হিসেবে দেখছেন না। কৃত্রিমভাবে পরিবেশ তৈরি করে শীঘ্রই মঙ্গলে আরো এক বিস্ময়কর অভিযান চলবে।" অনিক যেন কিছুটা আশার আলো খুঁজে পেল। অনিক কিছু একটা বলতে যাবে ঠিক সে সময় সে কিছুটা চমকে উঠল। অনিক দেখল সে রসায়ন বইয়ের উপর মাথা দিয়ে ঘুমাচ্ছিল।তাহলে কি সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল? সে কি সত্যি সত্যি লাল গ্রহে যায়নি? তবে এসব নিয়ে ভাবার সময় এখন আর নেই। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো এখন রাত ১ টা বাজে ৫ মিনিট। অনিকের এখনো জৈব যৌগ পড়া বাকি। তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে সে আবার মন দিলো জৈব যৌগের মার্কনিকভ এবং খরাসের নীতিতে।